মেধা থাকলেই ভাল ডাক্তার হয় না

অভিজিৎ চৌধুরী

medical camp

মে-জুন মেধার মধুমাস। পরীক্ষার দাঁড়িপাল্লায় সাফল্যের ভার মেপে উল্লাসে ফেটে পড়া, স্বপ্নে বিভোর হওয়ার সময়। পাশাপাশি, ব্যর্থতার হিসেবনিকেশ, হা-হুতাশ, গাঢ় ধূসর ক্যানভাস তৈরি করে আলোর ছবিটাকে আরও উজ্জ্বল করে। ঝুড়ি-ঝুড়ি বইপত্তর, নাক-মুখ গুঁজে টিউটর-এর টোলে ‘নম্বর’ তোলার বড়ি গেলা, নিশ্চিত সাফল্যের ঢাকঢোলে মুগ্ধ হয়ে কোন পাঠশালায় নাম লেখানো বেশি ফলদায়ী, তা নিয়ে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা, সবই এই বছর দুয়েকের ঘোড়দৌড়ের গীতিকথার অংশ। ‘শিয়োর সাকসেস’ প্রকাশনীর সঙ্গে আইপিএল গোছের বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন আর তার পর ভো-কাট্টা উল্লাসে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে পড়া— সবই নতুন ছায়াছবির অংশ। ছেলের প্রতিপত্তি হবে সমাজে, আর তার সঙ্গে টাকাপয়সা। ডাক্তারি পড়াটা তাই হালফিল মেধাবী ছেলেপুলেদের ‘ঈশ্বর কণা’ অনুসন্ধানের একমাত্র পথ। স্টেথো দুলিয়ে, এপ্রন চাপিয়ে বছর চারেক সময় কাটানো, তার পর আর পায় কে!
চিকিৎসাশিক্ষায় ভাল ছেলেমেয়েরা চিরকালই এসে থাকেন। নতুন যা, তা হচ্ছে, এঁরা কোন মন আর চোখ নিয়ে এ পেশায় আসছেন। কষ্টে থাকা মানুষকে ভাল করা আর ভাল রাখার যজ্ঞে ব্রতী হতে গেলে যে মানসিকতা, সংস্কৃতি আর দর্শন-ভাবনায় সম্পৃক্ত হতে হয়, তা এঁদের বড় অংশের আছে কি? চিন্তাটা থাকছেই। আর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় তা বাড়ছে। সারা দেশের চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রের পরিমণ্ডলে খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটছে, যা খুব সুখদায়ী নয়। সমাজভাবনার দিক দিয়ে এর প্রেক্ষিত আলোচনার আগে কয়েকটি দৃশ্যপটের অবতারণা বিষয়টাকে খোলসা করতে পারে।
দৃশ্য এক। চরম নীরবতার মধ্যে একটি স্কুলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা চলছে। স্কুলের প্রধান ফটকের বাইরে জটলা করা অভিভাবকের দল। এঁদের অনেকেই কাজের জায়গায় মাসখানেক বা তারও বেশি ছুটি নিয়েছেন ছেলেমেয়েদের পিছনে সময় দেওয়ার জন্য। সাধ্যের বাইরে গিয়েও টাকা ঢেলেছেন কোচিং কিনতে। অনেকেই এই বাজার সম্পর্কে এত তথ্য জোগাড় করেছেন যে তা অন্য কাউকে সন্ত্রস্ত বা সংশয়াচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট।
দৃশ্য দুই। পরীক্ষাকেন্দ্রের দরজা খুলে যায়। ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে স্থূলকায় বালক আধখানা হাসি হেসে বেরিয়ে আসে। ‘স্যরের কোচিং-এর অনেকগুলোই কমন এসেছে, আর একটু সময় পেলে আরও ভাল হত।’ তৃপ্ত মা হাঁক পাড়েন, ছেলের হাত ধরে, ‘গাড়ির এসি-টা জোরে চালাও।’
এ দেশে, এ রাজ্যে এখন যাঁরা ডাক্তারি পড়তে আসেন, তাঁদের মানসপট আর সামাজিক অবস্থানের ছবি এটাই। টুকরো ছবিগুলো জোড়া মারলে তা আমাদের সত্যিই চিন্তায় ফেলে। তার কারণ, ‘অ্যাটিটিউড’ আর ‘অ্যাপ্টিটিউড’, এই দুইয়ের মিশ্রণ ঘটিয়েই শিক্ষণের যৌক্তিকতা ঠিক করা হয়। এ দেশে বা রাজ্যে সে সবের কোনও বালাই নেই। একটাই অ্যাটিটিউড— রোজগার নিশ্চিত এ পেশায়। এখানে কখনও ভাটা আসে না। কলেজে ঢোকার সময় থেকেই আত্মবিস্মৃতি আর শঠতার এক মায়াজাল আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলে মাথাগুলোকে। ‘গায়ত্রী’ জপের মতো এঁরা হিপোক্রেটিক শপথ আওড়ান। ফিসফিসিয়ে শোনা যায় ‘আরে পড়ে যা, মন্ত্রীরাও তো এ দেশে শপথ নেয় দেশের মানুষকে স্বার্থহীন ভাবে সেবা করার কথা বলে।’ অতএব, গাণিতিক নিয়মে ধীমানের ছাপ পাওয়া এই ছেলেপুলেদের একটা বড় অংশ খুব দ্রুত ‘আর্তমানবতা’ শব্দকে সোনার পাথরবাটির সঙ্গে তুলনা করার ক্ষমতা অর্জন করেন। দুঃখ দেখে আলোড়িত না হওয়ার দৃঢ়তা চিকিৎসা-পেশা এমনিতেই দেয়। কিন্তু দুঃখ নিবারণে চোয়াল শক্ত করে হাঁটার যে আত্মিক ক্ষমতা চিকিৎসকের পাথেয়, তা অর্জন করাটাও জরুরি। যে নব্য প্রজন্মের আলেখ্য এখানে আলোচনা হচ্ছে, তাঁরা বরং বুদ্ধিমত্তার প্যাঁচ দিয়ে দুঃখের বালি খুঁড়ে লাভের গুড় কী ভাবে পাওয়া যায়, তার সুলুক সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
‘আস্তাবল’-এর ঘ্রাণ সত্যিই নাক ঝাঁঝায়, যখন এঁদেরই এক অংশ ‘কোরবান শেখ’কে আরশোলা বানান। পথবাসী ভিক্ষুকের দেহের ক্ষতে পোকা দেখে নাকে রুমাল চাপা দেন। জুতো পরিষ্কারে এঁরা যতটা মনোযোগী থাকেন, তার ক্ষুদ্রাংশও দেখা যায় না গরিবের ঘা’তে অ্যান্টিসেপ্টিক ড্রেসিং লাগানোর সময়। মেধাবী অথচ উদ্ধত, দুর্বিনীত, জীবনের প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধা নিয়ে বড় হয়ে ওঠা এক প্রজাতি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভিড় বাড়াচ্ছে। সাদাসিধে, পড়াশোনায় মনোযোগী ছেলেরা এদের দেখে সিঁটিয়ে থাকছে, কিংবা হয়ে পড়ছে প্রভাবিত। আঠারোর পর মানুষের সামগ্রিক জীবনবোধ, নান্দনিক ধ্যানধারণা খুব একটা পাল্টায় না। চিন্তাটা এই কারণেই আরও বেশি।
চিত্রটা এ রকম ছিল না কিছু দিন আগেও। উচ্চবিত্তনন্দন, ডাক্তার হবেন, এটা বহুদিন আগে থেকেই জানা। নিম্নবিত্ত এমনকী গরিব ঘরের মফস্সল ও গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা মেডিক্যাল কলেজে আসতে শুরু করেন সত্তরের দশক থেকে। সামাজিক ন্যায় আর গণতান্ত্রিক ভাবনার সামগ্রিক প্রসারও এ দেশে সে সময়ই। এই ধারার অনুসারীদের সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধগত ভাবনা একটু আলাদা ছিল বলেই, আর সংখ্যাতেও এঁরা বেশি থাকার ফলে সত্তর-আশি এমনকী নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক ন্যায়ের ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার একটা প্রবণতা দেখা যেত। বিত্তশালী, শহুরে ছেলেরাও এই বাতাবরণে সমাজবোধে দীপ্ত ও প্রভাবিত হতেন। এর পরেই শুরু উলটপুরাণ। চিকিৎসা প্রবেশিকা পরীক্ষাকে ‘একমাত্র’ মেধাভিত্তিক করার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষাকে তাৎক্ষণিক দক্ষতা-নির্ভর ‘টিক’ কিংবা ‘গোল’ করার পদ্ধতির আমদানির সময় থেকেই হট্টমেলার শুরু। এবং দেখতে দেখতে এরই অনুসারী শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে জাদুকর ম্যানড্রেক তৈরির নানান কারখানা, যেখানে শেখানো হয় সাফল্যের নানান কেরামতি, অবশ্যই কনকমূল্যে। এই প্রবাহই এখন সমুদ্র হয়েছে, আর আমরা তার নোনা জল খেয়ে পেট ভরাচ্ছি।
এর প্রভাব পড়ছে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষণ পরিমণ্ডলেও। আগে ক্লাসে, ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে পড়াশোনাটাই রীতি ছিল। ‘জড়িবুটি’ খেয়ে যাদের ছেলেবেলা কেটেছে, সেই ধীমানের দল মেডিক্যাল কলেজে এসেও নেশার আখড়া খোঁজেন। আর তা পরিবেশন করার জন্যও মানুষের অভাব নেই। রণপা ছাড়া যাঁরা চলতে শেখেননি, তাঁরা মেডিক্যাল কলেজে ঢুকেই ভিড় জমাতে শুরু করেন কলেজেরই শিক্ষকের প্রভাতী কিংবা বৈকালিক ‘বাউল আখড়া’য়। এতে সাফল্যের তাৎক্ষণিক নিশ্চয়তা বৃদ্ধি আর্থিক বিনিয়োগের সঙ্গেই সামঞ্জস্য রেখে ঘটে থাকে বলে প্রচার।
নেট ফল: হোম-সেন্টারে পরীক্ষা হবে না শুনলেই মেডিক্যাল কলেজে আতঙ্ক, অসহায় বোধ আর তার পর আন্দোলন সংগ্রাম নামের খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে তা আটকানোর চেষ্টা। ‘পোল্ট্রি’র মুরগি যেমন খাঁচার বাইরে বিশেষ বেরোতে পারে না— ওড়ার তো ক্ষমতাই থাকে না— এদেরও সেই অবস্থা। শুধু খাঁচা নোংরা করা আর কী! চিকিৎসকের দরকার মেডিক্যাল কলেজের পড়াশোনার সময় জ্ঞানের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে আর তার প্রায়োগিক ব্যুৎপত্তিতে দক্ষ হয়ে মানুষের মাঝে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু নব্য ধারণা সমৃদ্ধ এই কুশীলবেরা জনপদে অসহায়। বরঞ্চ তারা ‘সেন্টারে’ স্বাচ্ছন্দ্য, যেখানে যন্ত্র ঢাকা দেয় পারদর্শিতাকে।
বিলাপ শোনালেও ঘটনা হল, চিকিৎসা শিক্ষা এ দেশে ও রাজ্যে যে বাস্তববিমুখ পথে হাঁটছে, তা আতঙ্কিত করার মতোই। এর কোনও একমুখী সমাধানও সামনে নেই। দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবনের সমস্যা শোনার ও বোঝার ক্ষমতা এবং ইচ্ছা যদি চিকিৎসকদের না থাকে, তা হলে চিকিৎসাশিক্ষার ব্যবস্থা সমাজের প্রয়োজন মেটাবে না, কাকতাড়ুয়ার জন্ম দেবে। চিকিৎসাশিক্ষায় কারা আসবেন, তা ঠিক করতে যান্ত্রিকতাবর্জিত পদ্ধতি দরকার। প্রান্তিক মানুষজনের প্রতিনিধিত্বই শুধু সুনিশ্চিত করা নয়, প্রান্তিক জীবনের চর্চার মানসিকতাও তৈরি করা দরকার চিিকৎসকদের মধ্যে। চিকিৎসাশিক্ষার পাঠ্যক্রম ও তার বিন্যাসও দেশের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল রেখে হওয়া দরকার। সবাই স্পেশালিস্ট হবেন না, কিন্তু ‘স্পেশাল মানসিকতা’র যেন না হন।
যে সামাজিক অবস্থান থেকেই চিকিৎসার পেশায় আসুন না কেন, মানবিকতার জায়গাটা ঠুনকো হলে খুবই সমস্যা। আর এটা সত্যিই জীবনবোধের প্রশ্ন। অনেক উচ্চবিত্তের সন্তানই স্নেহময় চিকিৎসক হন। অন্য দিকে, প্রান্তিক সমাজ থেকে বড় হয়ে অনেকেই জীবন ঢালেন শুধু বিত্ত অর্জনে, চিত্তের পবিত্রতায় নয়। সামগ্রিক ভাবে উপরচালাকি এবং ‘ব্রহ্মত্ব’-এর অশালীন চর্চা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে বাড়ছে। রাশ টানা জরুরি।

চিকিৎসক, লিভার ফাউন্ডেশন-এর অধিকর্তা

Popular posts from this blog

PG Doctors of India must work not more than 48 Hr/week: SC

Sarita murder case: Details of the police version