এমডি হবেন? আগে তিন বছর গ্রামে থাকুন


মেডিক্যালে স্নাতকোত্তর (এমডি, এমএস) পড়ার জন্য এ বার থেকে সরকারি ডাক্তারদের কমপক্ষে তিন বছর গ্রামাঞ্চলে কাজ করে আসতেই হবে। না হলে স্নাতকোত্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার সুযোগই পাবেন না তাঁরা।

গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফেরাতে সরকারি ডাক্তারদের জন্য এই নতুন কড়াকড়ি চালু করল রাজ্য সরকার। ‘গ্রামাঞ্চল’ বলতে ঠিক কোন ধরনের এলাকাকে বোঝানো হচ্ছে, তা-ও নির্দিষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে! গত ৩ ডিসেম্বর এই নিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। ২০১৬-র এন্ট্রান্স থেকে নতুন নিয়ম কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।

সাধারণত এমবিবিএস পাশ করার পর সরকারি চিকিৎসকদের প্রথম পোস্টিং গ্রামাঞ্চলে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিযোগ, সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসকেরই গ্রামে যেতে অনীহা। গ্রামের দিকে পোস্টিং হলেও কত তাড়াতাড়ি শহরের দিকে ফেরা যায়, সেটাই তাঁদের লক্ষ্য থাকে। ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসক পেতে স্বাস্থ্য দফতরের ঘাম ছুটে যায়। সেই কারণেই এই নতুন নিয়ম, জানাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর।

এত দিন নিয়ম ছিল— এমডি, এমএস-এর এন্ট্রান্সে বসার জন্য সরকারি ডাক্তারদের ক্ষেত্রে তিন বছর গ্রামে কাজ করা ‘বাঞ্ছনীয়’, কিন্তু ‘বাধ্যতামূলক’ নয়। তিন বছর গ্রামে কাজ করলে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য সবেতন ছুটি পাওয়া যে়ত। অন্যথায়, অর্থাৎ তিন বছর গ্রামে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকলে, সরকারি ডাক্তারকে পড়া চলাকালীন   স্টাইপেন্ড নিয়ে খুশি থাকতে হতো। এবং তাঁদের জন্য স্নাতকোত্তরে আসনসংখ্যাও ছিল কম।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবতোষ বিশ্বাস জানালেন, গড়পড়তা হিসেবে রাজ্যে এমডি-এমএস ডিগ্রির জন্য মোট আসন থাকে কমবেশি ৭০০টি। তার মধ্যে ৫০ শতাংশ আসন সর্বভারতীয় প্রতিযোগীদের জন্য। বাকি ৫০ শতাংশ রাজ্যের প্রতিযোগীদের জন্য। সেই ৫০ শতাংশের মধ্যে আবার ৪০ শতাংশ আসন সরকারি সবেতন ডাক্তারদের জন্য, যাঁরা তিন বছর গ্রামে কাজ করে এসেছেন। বাকি ৬০ শতাংশ ‘ওপেন ক্যাটিগরি’। সেখানে স্টাইপেন্ড নিয়ে সরকারি ডাক্তাররাও পড়তে পারেন, আবার বেসরকারি ছাত্ররাও পড়তে পারেন। ‘‘এত দিন তিন বছর গ্রামে কাজ করে না এলেও সরকারি ডাক্তাররা ওপেন ক্যাটিগরিতে স্নাতকোত্তর পড়তে পারতেন, অথবা সর্বভারতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় বসতেন।’’ নতুন নিয়মে সেই সুযোগ আর থাকবে না।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এখন থেকে স্নাতকোত্তরের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার যোগ্যতামান পেরোতে গেলেই সরকারি ডাক্তারদের জন্য গ্রামে তিন বছর কাজ করাটা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ওপেন ক্যাটিগরি বা সর্বভারতীয় স্তরের প্রতিযোগিতার সুযোগও কার্যত আর থাকছে না। কারণ স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন, ‘‘যে ক্যাটিগরিতেই পড়তে চান না কেন, সরকারি ডাক্তার হিসেবে সরকারের অনুমতি তো নিতেই হবে। সেটা আমরা দেব না। তার পরেও যদি কেউ পরীক্ষা দিয়ে এমডি বা এমএস পড়তে শুরু করেন, তাঁকে সরকারি চাকরি হারাতে হতে পারে।’’

স্নাতকোত্তর পাশ করার পরে ফের তিন বছর গ্রামে কাজ করার যে নিয়ম ছিল, তা-ও থাকছে। এমডি-এমএস পাশ করা ডাক্তাররা হয় কমপক্ষে তিন বছর গ্রামে যাবেন। নয় সরকারকে ক্ষতিপূরণের অর্থ গুনে দেবেন।

তবে ‘গ্রামাঞ্চল’-এর সংজ্ঞা এ বার নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। এত দিন জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল বা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে কাজ করলেও তাকে গ্রামাঞ্চলের কাজ বলে ধরে নেওয়া হত। কিন্তু নতুন নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে— কোনও মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি, নোটিফায়েড এরিয়া, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ-কে ‘গ্রামাঞ্চল’ বলে ধরা হবে না। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গ্রামীণ হাসপাতাল যেখানে রয়েছে তাকেই প্রকৃত ‘গ্রামাঞ্চল’ হিসেবে ধরা হবে। রাজ্য হেলথ সার্ভিসের আওতায় থাকা ডাক্তারেরা তিন বছর সেখানে পরিষেবা দিলে তবেই এমডি-এমএসের এন্ট্রান্সে বসতে পারবেন।

কেন এত কড়াকড়ি? শতপথীর উত্তর, ‘‘গ্রামে চাকরি করে সরকারকে সাহায্য করবেন না অথচ চটপট এমডি-এমএস পড়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়ে বসবেন, সেটা তো হয় না। অনেকে আবার স্নাতকোত্তর পাশ করেই সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। তাই আমরাও কড়া হচ্ছি।’’

কিন্তু সরকারি চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ নতুন নিয়মের বিরুদ্ধে ফুঁসছেন। তাঁদের অন্যতম সংগঠন ‘সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম’ যেমন দাবি করছে, অনেক চিকিৎসক এমবিবিএস পাশ করার পর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা গ্রামীণ হাসপাতালে কাজ করতে চেয়েছিলেন। পোস্টিংও পেয়েছিলেন। কিন্তু জেলা বা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে লোকের অভাবের কথা বলে সরকারই তাঁদের তুলে সেখানে নিয়ে গিয়েছে। ফোরামের অভিযোগ, এখন সরকারই বলছে জেলা বা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল গ্রামাঞ্চল বলে গণ্য হবে না! বিনা দোষে ডাক্তারদের কেরিয়ার কেন ধাক্কা খাবে?

সরকারি চিকিৎসকদের আর একটি সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’-এর অভিযোগ, সরকার একের পর এক সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ), হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) খুলছে। সে‌গুলি সবই জেলা সদর বা মহকুমায়। নতুন নিয়মে তা গ্রামাঞ্চল হিসাবে গণ্য হবে না। তা হলে ডাক্তারেরা সেখানে যেতে চাইবেন কেন? এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিকর্তার মন্তব্য, ‘‘এসএনসিইউ বা আইসিইউ-এর ডাক্তারদের ব্যাপারে আমরা নিয়মে একটা সংশোধন আনার কথা ভাবছি।’’

কিন্তু বিদ্রোহী চিকিৎসকদের বক্তব্য, ‘‘একেই রাজ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আকাল। তার উপরে এত কড়াকড়ি হলে মেডিক্যাল কলেজ বা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে আর ডাক্তার পেতে হবে না। আমরা চাকরি ছেড়ে দেব।’’ তা হলে কি নতুন নিয়মের গেরোয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা কমে যেতে পারে? স্বাস্থ্য অধিকর্তা এই আশঙ্কায় আমল দিতে চাননি। তাঁর যুক্তি, ‘‘সরকারি কোটায় আগেও যত আসন ছিল এখনও তাই-ই থাকছে। এক জন ছেড়ে দিলে অন্য জন পড়বেন। ফলে আগেও যত বিশেষজ্ঞ পাশ করে বেরোতেন, এখনও তা-ই বেরোবেন।’’ বিদ্রোহীরা বলছেন, প্রশ্নটা সংখ্যার নয়, মানের। এমনিতেই ডাক্তারির ভাল ছাত্ররা সরকারি চাকরি নিতে চান না বলে অভিযোগ। নিয়মের ফাঁসে সেই প্রবণতা আরও বাড়তে পারে, এমন সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলেই তাঁদের দাবি।

Popular posts from this blog

PG Doctors of India must work not more than 48 Hr/week: SC

Sarita murder case: Details of the police version